এই নিবন্ধে তুলে ধরছি ৫ টি সেরা নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতা। কবিতা গুলো হলো ছাত্রদলের গান, শ্রমিকের গান, যুগান্তরের গান, শিকল-পরার গান ও সর্বহারা। কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম মুক্তি, যেই কবিতাটি তার জীবনে প্রথম খ্যাতি এনে দেয় তার নাম ‘বিদ্রোহী’। পরবর্তীকালে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতা
১. ছাত্রদলের গান
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান
উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়!
যুগে-যুুগে রক্তে মোদের
সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায়
লক্ষহারা প্রাণ,
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন,
আমরা পশি নীল অতল,
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার
যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
হাসির দেশে আমরা আনি
সর্বনাশী চোখের জল।
আমরা ছাত্রদল।।
সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়,
আমরা করি ভুল।
সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
আমরা ভাঙি কূল।
দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ
রক্তে করি পথ পিছল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক্,
কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন
নিত্য কালের ডাক।
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
সরস্বতীর শ্বেত কমল।
আমরা ছাত্রদল।।
ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে
আমরা দানি শির,
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
বিংশ শতাব্দীর!
মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল।
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা রচি ভালোবাসার
আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়াপথ!
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল।।
২. শ্রমিকের গান
ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
আমরা হাতের সুখে গড়েছি ভাই,
পায়ের সুখে ভাঙব চল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমাদেরই শক্তিবলে
পাহাড় টলে তুষার গলে
মরুভূমে সোনার ফসল ফলে রে!
মোরা সিন্ধু মথে এনে সুধা
পাই না ক্ষুধায় বিন্দু জল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমরা কলির কলের কুলি,
কলুর বলদ চক্ষে-ঠুলি
হিরা পেয়ে রাজ-শিরে দিই তুলি রে!
আজ মানবকুলের কালি মেখে
আমরা কালো কুলির দল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।
আমরা পাতাল ফেড়ে খুঁড়ে খনি
আমি ফণীর মাথার মণি,
তাই পেয়ে সব শনি হল ধনী রে!
এবার ফণীমনসার নাগ-নাগিনি
আয় রে গর্জে মার ছোবল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা
রাজা-উজির মারছে মজা,
আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝা রে।
এবার জুজুর দল ওই হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই মোদের বলে হতেছে পার,
হপ্তা রোজে সপ্ত পাথার,
সাঁতার কেটে জাহাজ কাতার কাতার রে!
তবু মোরাই জনম চলছি ঠেলে
ক্লেশ-পাথারের সাঁতার-জল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
আজ ছ-মাসের পথ ছ-দিনে যায়
কামান-গোলা, রাজার সিপাই
মোদের শ্রমে মোদেরই সে কৃপায় রে!
ও ভাই মোদের পুণ্যে শূন্যে ওড়ে
ওই জ্ঞুঁড়োদের উড়োকল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই দালান-বাড়ি আমরা গড়ে
রইনু জনম ধুলায় পড়ে,
বেড়ায় ধনী মোদের ঘাড়ে চড়ে রে!
আমরা চিনির বলদ চিনিনে স্বাদ
চিনি বওয়াই সার কেবল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমরা মায়ের ময়লা ছেলে
কয়লা-খনির বয়লা ঠেলে
যে অগ্নি দিই দিগ্বিদিকে জ্বেলে রে!
এবার জ্বালবে জগৎ কয়লা-কাটা
ময়লা কুলির সেই অনল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ও ভাই আমাদের কাজ হলে বাসি
আমরা মুটে কল-খালাসি!
ডুবলে তরি মোরাই তুলতে আসি রে!
আমরা বলির মতন দান করে সব
পেলাম শেষে পাতাল-তল
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
মোদের যা ছিল সবই দিইছি ফুঁকে,
এইবারে শেষ কপাল ঠুকে
পড়ব রুখে অত্যাচারীর বুকে রে!
আবার নূতন করে মল্লভূমে
গর্জাবে ভাই দল-মাদল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল॥
ওই শয়তানি চোখ কলের বাতি
নিবিয়ে আয় রে ধ্বংস-সাথি!
ধর হাথিয়ার, সামনে প্রলয়-রাতি রে!
আয় আলোক-স্নানের যাত্রীরা আয়
আঁধার-নায়ে চড়বি চল!
ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল॥
৩. সর্বহারা
ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর,
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
হাট তুলে দে সর্বহারা,
মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা
ঝ’রছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
দুলিয়ে তর”-কর।।
কন্যারা তোর বন্যাধারায়
কাঁদছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
সাগর-মায়ের কোল।
নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
পাল তু’লে তুই দে রে আজি
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
তরঙ্গে খায় দোল।
নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
মায়ার নোঙর তোল্।
ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
যায় রে বেলা যায়।
মাঝি রে! দেখ্ কুরঙ্গী তোর
কূলের পানে চায়।
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
ঘুমুস্ নে আর, হায়!
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
এতই কি রে দায়?
হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
চাস্নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
একটু-কুটীর-দোর।
আস্ল মৃত্যু আস্ল জরা,
আস্ল সিঁদেল-চোর।
মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল্!
শক্তমাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চ’ল্বি ফিরি
দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
নাচছে সিন্ধুজল।
চল্ রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল্ ।।
৪. যুগান্তরের গান
বলো ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নবযুগ ওই এল ওই
এল ওই রক্ত-যুগান্তর রে।
বলো জয় সত্যের জয়
আসে ভৈরব-বরাভয়
শোনো অভয় ওই রথ-ঘর্ঘর রে॥
রে বধির! শোন পেতে কান
ওঠে ওই কোন্ মহা-গান
হাঁকছে বিষাণ ডাকছে ভগবান রে।
জগতে জাগল সাড়া
জেগে ওঠ উঠে দাঁড়া
ভাঙ পাহারা মায়ার কারা-ঘর রে।
যা আছে যাক না চুলায়
নেমে পড় পথের ধুলায়
নিশান দুলায় ওই প্রলয়ের ঝড় রে।
সে ঝড়ের ঝাপটা লেগে
ভীম আবেগে উঠনু জেগে
পাষাণ ভেঙে প্রাণ-ঝরা নির্ঝর রে।
ভুলেছি পর ও আপন
ছিঁড়েছি ঘরের বাঁধন
স্বদেশ স্বজন স্বদেশ মোদের ঘর রে।
যারা ভাই বদ্ধ কুয়ায়
খেয়ে মার জীবন গোঁয়ায়
তাদের শোনাই প্রাণ-জাগা মন্তর রে।
ঝড়ের ঝাঁটার ঝাণ্ডার নেড়ে
মাভৈঃ-বাণীর ডঙ্কা মেরে
শঙ্কা ছেড়ে হাঁক প্রলয়ংকর রে।
তোদের ওই চরণ-চাপে
যেন ভাই মরণ কাঁপে,
মিথ্যা পাপের কণ্ঠ চেপে ধর রে।
শোনা তোর বুক-ভরা গান,
জাগা ফের দেশ-জোড়া প্রাণ,
যে বলিদান প্রাণ ও আত্মপর রে॥
মোরা ভাই বাউল চারণ,
মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।
দেখে ওই ভয়ের ফাঁসি
হাসি জোর জয়ের হাসি,
অ-বিনাশী নাইকো মোদের ডর রে!
গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই,
মরা-প্রাণ উটকে দেখাই
ছাই-চাপা ভাই অগ্নি ভয়ংকর রে॥
খুঁড়ব কবর তুড়ব শ্মশান
মড়ার হাড়ে নাচাব প্রাণ
আনব বিধান নিদান কালের বর রে।
শুধু এই ভরসা রাখিস
মরিসনি ভিরমি গেছিস
ওই শুনেছিস ভারত-বিধির স্বর রে।
ধর হাত ওঠ রে আবার
দুর্যোগের রাত্রি কাবার,
ওই হাসে মা-র মূর্তি মনোহর রে॥
৫. শিকল-পরার গান
এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥
তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দি হতে নয়,
ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে করব মোরা জয়,
এই শিকলবাঁধা পা নয় এ শিকলভাঙা কল॥
তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস,
আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছ বিধির শক্তি হ্রাস।
সেই ভয়-দেখানো ভূতের মোরা করব সর্বনাশ,
এবার আনব মাভৈঃ-বিজয়মন্ত্র বলহীনের বল॥
তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;
সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।
মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,
মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল॥
ওরে ক্রন্দন নয়, বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,
এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা।
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা,
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল॥
নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতা গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে ৫ স্টার রেটিং দিতে ও শেয়ার করতে ভুলবেন না।