এই নিবন্ধে আপনার সামনে তুলে ধরছি ৫ টি বাছাই করা বন্ধু নিয়ে কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা। কবিতা গুলো হলো খেলা, কাঁচা আম, ঝড়ের দিনে, বিদায় ও চিত্রকূট। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সবসময় পাশে পাওয়া মানুষ গুলোই হলো আমাদের পরম বন্ধু, যাদের সঙ্গে কারো তুলনা হয় না। বন্ধুত্বের সঙ্গে একনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবি ঠাকুর তার কবিতা, গানে ও সাহিত্য দিয়ে তুলে ধরেছেন বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন।
বন্ধু নিয়ে কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১. খেলা
মনে পড়ে সেই আষাঢ়ে
ছেলেবেলা,
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা।
বৃষ্টি পড়ে দিবস- রাতি,
ছিল না কেউ খেলার সাথি,
একলা বসে পেতেছিলেম
সাধের খেলা।
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা।
হঠাৎ হল দ্বিগুণ আঁধার
ঝড়ের মেঘে,
হঠাৎ বৃষ্টি নামল কখন
দ্বিগুণ বেগে।
ঘোলা জলের স্রোতের ধারা
ছুটে এল পাগল- পারা
পাতার ভেলা ডুবল নালার
তুফান লেগে-
হঠাৎ বৃষ্টি নামল যখন
দ্বিগুণ বেগে।
সেদিন আমি ভেবেছিলেম
মনে মনে,
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে।
ঝড় এল যে আচম্বিতে
পাতার ভেলা ডুবিয়ে দিতে,
আর কিছু তার ছিল না কাজ
ত্রিভুবনে।
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে।
আজ আষাঢ়ে একলা ঘরে
কাটল বেলা,
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা।
ভাগ্য- ‘পরে করিয়া রোষ
দিতেছিলেম বিধিরে দোষ-
পড়ল মনে, নালার জলে
পাতার ভেলা।
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা।
- আরও পড়ুন:
- ৫ টি সেরা কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প ললাটের লিখন
- কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প অপরিচিতা
২. কাঁচা আম
তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্দুরে।
যখন- দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে।
তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম,
বদল হয়েছে পালের হাওয়া
পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে।
সেদিন গেছে যেদিন দৈবে- পাওয়া দুটি- একটি কাঁচা আম ছিল আমার সোনার চাবি,
খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি;
আজ সে তালা নেই, চাবিও লাগে না।
গোড়াকার কথাটা বলি।
আমার বয়সে এ বাড়িতে যেদিন প্রথম আসছে বউ পরের ঘর থেকে, সেদিন যে- মনটা ছিল নোঙর- ফেলা নৌকো বান ডেকে তাকে দিলে তোলপাড় করে।
জীবনের বাঁধা বরাদ্দ ছাপিয়ে দিয়ে
এল অদৃষ্টের বদান্যতা।
পুরোনো ছেঁড়া আটপৌরে দিনরাত্রিগুলো
খসে পড়ল সমস্ত বাড়িটা থেকে।
কদিন তিনবেলা রোশনচৌকিতে
চার দিকের প্রাত্যহিক ভাষা দিল বদলিয়ে;
ঘরে ঘরে চলল আলোর গোলমাল
ঝাড়ে লণ্ঠনে।
অত্যন্ত পরিচিতের মাঝখানে
ফুটে উঠল অত্যন্ত আশ্চর্য।
কে এল রঙিন সাজে সজ্জায়,
আলতা- পরা পায়ে পায়ে-
ইঙ্গিত করল যে, সে এই সংসারের পরিমিত দামের মানুষ নয়-
সেদিন সে ছিল একলা অতুলনীয়।
বালকের দৃষ্টিতে এই প্রথম প্রকাশ পেল-
জগতে এমন কিছু যাকে দেখা যায় কিন্তু জানা যায় না।
বাঁশি থামল, বাণী থামল না-
আমাদের বধূ রইল
বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা।
তার ভাব, তার আড়ি, তার খেলাধুলো ননদের সঙ্গে।
অনেক সংকোচে অল্প একটু কাছে যেতে চাই,
তার ডুরে শাড়িটি মনে ঘুরিয়ে দেয় আবর্ত;
কিন্তু, ভ্রূকুটিতে বুঝতে দেরি হয় না, আমি ছেলেমানুষ, আমি মেয়ে নই, আমি অন্য জাতের।
তার বয়স আমার চেয়ে দুই- এক মাসের
বড়োই হবে বা ছোটোই হবে।
তা হোক, কিন্তু এ কথা মানি, আমরা ভিন্ন মসলায় তৈরি।
মন একান্তই চাইত, ওকে কিছু একটা দিয়ে
সাঁকো বানিয়ে নিতে।
একদিন এই হতভাগা কোথা থেকে পেল
কতকগুলো রঙিন পুথি; ভাবলে, চমক লাগিয়ে দেবে।
হেসে উঠল সে; বলল,
“এগুলো নিয়ে করব কী।”
ইতিহাসের উপেক্ষিত এই- সব ট্র্যাজেডি
কোথাও দরদ পায় না,
লজ্জার ভারে বালকের সমস্ত দিনরাত্রির
দেয় মাথা হেঁট করে।
কোন্ বিচারক বিচার করবে যে, মূল্য আছে
সেই পুঁথিগুলোর।
তবু এরই মধ্যে দেখা গেল, শস্তা খাজনা চলে
এমন দাবিও আছে ওই উচ্চাসনার-
সেখানে ওর পিড়ে পাতা মাটির কাছে।
ও ভালোবাসে কাঁচা আম খেতে
শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে।
প্রসাদলাভের একটি ছোট্ট দরজা খোলা আছে
আমার মতো ছেলে আর ছেলেমানুষের জন্যেও।
গাছে চড়তে ছিল কড়া নিষেধ।
হাওয়া দিলেই ছুটে যেতুম বাগানে,
দৈবে যদি পাওয়া যেত একটিমাত্র ফল
একটুখানি দুর্লভতার আড়াল থেকে,
দেখতুম, সে কী শ্যামল, কী নিটোল, কী সুন্দর,
প্রকৃতির সে কী আশ্চর্য দান।
যে লোভী চিরে চিরে ওকে খায়
সে দেখতে পায় নি ওর অপরূপ রূপ।
একদিন শিলবৃষ্টির মধ্যে আম কুড়িয়ে এনেছিলুম; ও বলল, “কে বলেছে তোমাকে আনতে। আমি বললুম, “কেউ না।”
ঝুড়িসুদ্ধ মাটিতে ফেলে চলে গেলুম।
আর- একদিন মৌমাছিতে আমাকে দিলে কামড়ে; সে বললে, “এমন করে ফল আনতে হবে না।” চুপ করে রইলুম।
বয়স বেড়ে গেল। একদিন সোনার আংটি পেয়েছিলুম ওর কাছ থেকে;
তাতে স্মরণীয় কিছু লেখাও ছিল।
স্নান করতে সেটা পড়ে গেল গঙ্গার জলে-
খুঁজে পাই নি। এখনো কাঁচা আম পড়ছে খসে খসে গাছের তলায়, বছরের পর বছর।
ওকে আর খুঁজে পাবার পথ নেই।
৩. ঝড়ের দিনে
আজি এই আকুল আশ্বিনে
মেঘে- ঢাকা দুরন্ত দুর্দিনে
হেমন্ত- ধানের খেতেবাতাস উঠেছে মেতে,
কেমনে চলিবে পথ চিনে?
আজি এই দুরন্ত দুর্দিনে!
দেখিছ না ওগো সাহসিকা,
ঝিকিমিকি বিদ্যুতের শিখা!
মনে ভেবে দেখো তবেএ ঝড়ে কি বাঁধা রবে
কবরীর শেফালিমালিকা।
ভেবে দেখো ওগো সাহসিকা!
আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়
নূপুর বাঁধে কি কেহ পায়?
যদি আজি বৃষ্টির জলধুয়ে দেয় নীলাঞ্চল
গ্রামপথে যাবে কি লজ্জায়
আজিকার এমন ঝঞ্ঝায়?
হে উতলা শোনো কথা শোনো,
দুয়ার কি খোলা আছে কোনো?
এ বাঁকা পথের শেষেমাঠ যেথা মেঘে মেশে
বসে কেহ আছে কি এখনো?
এ দুর্যোগে, শোনো ওগো শোনো!
আজ যদি দীপ জ্বালে দ্বারে
নিবে কি যাবে না বারে বারে?
আজ যদি বাজে বাঁশিগান কি যাবে না ভাসি
আশ্বিনের অসীম আঁধারে
ঝড়ের ঝাপটে বারে বারে?
মেঘ যদি ডাকে গুরু গুরু
নৃত্যমাঝে কেঁপে ওঠে ঊরু,
কাহারে করিবে রোষ, কার ‘পরে দিবে দোষ
বক্ষ যদি করে দুরু দুরু-
মেঘ ডেকে ওঠে গুরু গুরু।
যাবে যদি, মনে ছিল না কি,
আমারে নিলে না কেন ডাকি?
আমি তো পথেরি ধারেবসিয়া ঘরের দ্বারে
আনমনে ছিলাম একাকী-
আমারে নিলে না কেন ডাকি?
কখন প্রহর গেছে বাজি,
কোনো কাজ নাহি ছিল আজি।
ঘরে আসে নাই কেহ, সারাদিন শূন্য গেহ,
বিলাপ করেছে তরুরাজি।
কোনো কাজ নাহি ছিল আজি।
যত বেগে গরজিত ঝড়,
যত মেঘে ছাইত অম্বর,
রাত্রে অন্ধকারে যতপথ অফুরান হত
আমি নাহি করিতাম ডর-
যত বেগে গরজিত ঝড়।
বিদ্যুতের চমকানি- কালে
এ বক্ষ নাচিত তালে তালে,
উত্তরী উড়িত মমউন্মুখ পাখার সম-
মিশে যেত আকাশে পাতালে
বিদ্যুতের চমকানি- কালে।
তোমায় আমায় একত্তর
সে যাত্রা হইত ভয়ংকর।
তোমার নূপুর আজিপ্রলয়ে উঠিত বাজি,
বিজুলি হানিত আঁখি- ‘পর-
যাত্রা হত মত্ত ভয়ংকর।
কেন আজি যাও একাকিনী?
কেন পায়ে বেঁধেছ কিঙ্কিণী?
এ দুর্দিনে কী কারণেপড়িল তোমার মনে
বসন্তের বিস্মৃত কাহিনী?
কোথা যাও আজ একাকিনী?
৪. বিদায়
তোমরা নিশি যাপন করো,
এখনো রাত রয়েছে ভাই,
আমায় কিন্তু বিদায় দেহো-
ঘুমোতে যাই, ঘুমোতে যাই।
মাথার দিব্য, উঠো না কেউ
আগ বাড়িয়ে দিতে আমায়-
চলছে যেমন চলুক তেমন,
হঠাৎ যেন গান না থামায়।
আমার যন্ত্রে একটি তন্ত্রী
একটু যেন বিকল বাজে,
মনের মধ্যে শুনছি যেটা
হাতে সেটা আসছে না যে।
একেবারে থামার আগে
সময় রেখে থামতে যে চাই-
আজকে কিছু শ্রান্ত আছি,
ঘুমোতে যাই, ঘুমোতে যাই।
আঁধার- আলোয় সাদায়- কালোয়
দিনটা ভালোই গেছে কাটি,
তাহার জন্যে কারো সঙ্গে
নাইকো কোনো ঝগড়াঝাঁটি।
মাঝে মাঝে ভেবেছিলুম
একটু- আধটু এটা- ওটা
বদল যদি পারত হতে
থাকত নাকো কোনো খোঁটা।
বদল হলে কখন মনটা
হয়ে পড়ত ব্যতিব্যস্ত,
এখন যেমন আছে আমার
সেইটে আবার চেয়ে বসত।
তাই ভেবেছি দিনটা আমার
ভালোই গেছে কিছু না চাই-
আজকে শুধু শ্রান্ত আছি,
ঘুমোতে যাই, ঘুমোতে যাই।
৫. চিত্রকূট
একটুখানি জায়গা ছিল
রান্নাঘরের পাশে,
সেইখানে মোর খেলা হ’ত
শুক্নো- পারা ঘাসে।
একটা ছিল ছাইয়ের গাদা
মস্ত ঢিবির মতো,
পোড়া কয়লা দিয়ে দিয়ে
সাজিয়েছিলেম কত।
কেউ জানে না সেইটে আমার
পাহাড় মিছিমিছি,
তারই তলায় পুঁতেছিলেম
একটি তেঁতুল- বিচি।
জন্মদিনের ঘটা ছিল,
ছয় বছরের ছেলে-
সেদিন দিল আমার গাছে
প্রথম পাতা মেলে।
চার দিকে তার পাঁচিল দিলেম
কেরোসিনের টিনে,
সকাল বিকাল জল দিয়েছি,
দিনের পরে দিনে।
জল- খাবারের অংশ আমার
এনে দিতেম তাকে,
কিন্তু তাহার অনেকখানিই
লুকিয়ে খেত কাকে।
দুধ যা বাকি থাকত দিতেম
জানত না কেউ সে তো-
পিঁপড়ে খেত কিছুটা তার,
গাছ কিছু বা খেত।
চিকন পাতায় ছেয়ে গেল,
ডাল দিল সে পেতে-
মাথায় আমার সমান হল
দুই বছর না যেতে।
একটি মাত্র গাছ সে আমার
একটুকু সেই কোণ,
চিত্রকূটের পাহাড়- তলায়
সেই হল মোর বন।
কেউ জানে না সেথায় থাকেন
অষ্টাবক্র মুনি-
মাটির ‘পরে দাড়ি গড়ায়,
কথা কন না উনি।
রাত্রে শুয়ে বিছানাতে
শুনতে পেতেম কানে
রাক্ষসেরা পেঁচার মতো
চেঁচাত সেইখানে।
নয় বছরের জন্মদিনে
তার তলে শেষ খেলা,
ডালে দিলুম ফুলের মালা
সেদিন সকাল- বেলা।
বাবা গেলেন মুন্শিগঞ্জে
রানাঘাটের থেকে,
কোল্কাতাতে আমায় দিলেন
পিসির কাছে রেখে।
রাত্রে যখন শুই বিছানায়
পড়ে আমার মনে
সেই তেঁতুলের গাছটি আমার
আঁস্তাকুড়ের কোণে।
আর সেখানে নেই তপোবন,
বয় না সুরধুনী-
অনেক দূরে চ’লে গেছেন
অষ্টাবক্র মুনি।
বন্ধু নিয়ে কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে ৫ স্টার রেটিং দিতে ও শেয়ার করতে ভুলবেন না।