৫ টি বাছাই করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা

5/5 - (3 votes)
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা নিয়ে আমাদের আজকের এই নিবন্ধটি। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা সমগ্র একটি আলোচিত ও জনপ্রিয় বিষয়। পূর্ববাংলা থেকে শুরু করে পশ্চিম বাংলায় সমান ভাবে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গল্প সমাদৃত। বাংলা উপন্যাস পড়তে গেলে সবার আগে চলে আসে রবি ঠাকুরের নাম। আজকের এই নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ৫ টি বিখ্যাত কবিতা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা অভিলাষ

জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ!
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার।
অতিক্রম করা যায় যত পান্থশালা,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয়।

তোমার বাঁশরি স্বরে বিমোহিত মন-
মানবেরা, ওই স্বর লক্ষ্য করি হায়,
যত অগ্রসর হয় ততই যেমন
কোথায় বাজিছে তাহা বুঝিতে না পারে।

চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে,
পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া,
তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ,
মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে।

হিমক্ষেত্র, জনশূন্য কানন, প্রান্তর,
চলিল সকল বাধা করি অতিক্রম।
কোথায় যে লক্ষ্যস্থান খুঁজিয়া না পায়,
বুঝিতে না পারে কোথা বাজিছে বাঁশরি।

ওই দেখো ছুটিয়াছে আর- এক দল,
লোকারণ্য পথমাঝে সুখ্যাতি কিনিতে;
রণক্ষেত্রে মৃত্যুর বিকট মূর্তি মাঝে,
শমনের দ্বার সম কামানের মুখে।

ওই দেখো পুস্তকের প্রাচীর মাঝারে
দিন রাত্রি আর স্বাস্থ্য করিতেছে ব্যয়।
পহুঁছিতে তোমার ও দ্বারের সম্মুখে
লেখনীরে করিয়াছে সোপান সমান।

কোথায় তোমার অন্ত রে দুরভিলাষ
“স্বর্ণঅট্টালিকা মাঝে?’ তা নয় তা নয়।
“সুবর্ণখনির মাঝে অন্ত কি তোমার?’
তা নয়, যমের দ্বারে অন্ত আছে তব।

তোমার পথের মাঝে, দুষ্ট অভিলাষ,
ছুটিয়াছে মানবেরা সন্তোষ লভিতে।
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা,
তোমার পথের মাঝে সন্তোষ থাকে না!

নাহি জানে তারা হায় নাহি জানে তারা
দরিদ্র কুটির মাঝে বিরাজে সন্তোষ।
নিরজন তপোবনে বিরাজে সন্তোষ।
পবিত্র ধর্মের দ্বারে সন্তোষ আসন।

নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
তোমার কুটিল আর বন্ধুর পথেতে
সন্তোষ নাহিকো পারে পাতিতে আসন।
নাহি পশে সূর্যকর আঁধার নরকে।

তোমার পথেতে ধায় সুখের আশয়ে
নির্বোধ মানবগণ সুখের আশয়ে;
নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
কটাক্ষও নাহি করে সুখ তোমা পানে।

সন্দেহ ভাবনা চিন্তা আশঙ্কা ও পাপ
এরাই তোমার পথে ছড়ানো কেবল
এরা কি হইতে পারে সুখের আসন
এ- সব জঞ্জালে সুখ তিষ্ঠিতে কি পারে।

নাহি জানে তারা ইহা নাহি জানে তারা
নির্বোধ মানবগন নাহি জানে ইহা
পবিত্র ধর্মের দ্বারে চিরস্থায়ী সুখ
পাতিয়াছে আপনার পবিত্র আসন।

ওই দেখো ছুটিয়াছে মানবের দল
তোমার পথের মাঝে দুষ্ট অভিলাষ
হত্যা অনুতাপ শোক বহিয়া মাথায়
ছুটেছে তোমার পথে সন্দিগ্ধ হৃদয়ে।

প্রতারণা প্রবঞ্চনা অত্যাচারচয়
পথের সম্বল করি চলে দ্রুতপদে
তোমার মোহন জালে পড়িবার তরে।
ব্যাধের বাঁশিতে যথা মৃগ পড়ে ফাঁদে।

দেখো দেখো বোধহীন মানবের দল
তোমার ও মোহময়ী বাঁশরির স্বরে
এবং তোমার সঙ্গী আশা উত্তেজনে
পাপের সাগরে ডুবে মুক্তার আশয়ে।

রৌদ্রের প্রখর তাপে দরিদ্র কৃষক
ঘর্মসিক্ত কলেবরে করিছে কর্ষণ
দেখিতেছে চারি ধারে আনন্দিত মনে
সমস্ত বর্ষের তার শ্রমের যে ফল।

দুরাকাঙক্ষা হায় তব প্রলোভনে পড়ি
কর্ষিতে কর্ষিতে সেই দরিদ্র কৃষক
তোমার পথের শোভা মনোময় পটে
চিত্রিতে লাগিল হায় বিমুগ্ধ হৃদয়ে।

ওই দেখো আঁকিয়াছে হৃদয়ে তাহার
শোভাময় মনোহর অট্টালিকারাজি
হীরক মাণিক্য পূর্ণ ধনের ভাণ্ডার
নানা শিল্পে পরিপূর্ণ শোভন আপণ।

মনোহর কুঞ্জবন সুখের আগার
শিল্প- পারিপাট্যযুক্ত প্রমোদভবন
গঙ্গা সমীরণ স্নিগ্ধ পল্লীর কানন
প্রজাপূর্ণ লোভনীয় বৃহৎ প্রদেশ।

ভাবিল মুহূর্ত- তরে ভাবিল কৃষক
সকলই এসেছে যেন তারি অধিকারে
তারি ওই বাড়ি ঘর তারি ও ভাণ্ডার
তারি অধিকারে ওই শোভন প্রদেশ।

মুহূর্তেক পরে তার মুহূর্তেক পরে
লীন হল চিত্রচয় চিত্তপট হতে
ভাবিল চমকি উঠি ভাবিল তখন
“আছে কি এমন সুখ আমার কপালে?’

“আমাদের হায় যত দুরাকাঙক্ষাচয়
মানসে উদয় হয় মুহূর্তের তরে
কার্যে তাহা পরিণত না হতে না হতে
হৃদয়ের ছবি হায় হৃদয়ে মিশায়।’

ওই দেখো ছুটিয়াছে তোমার ও পথে
রক্তমাখা হাতে এক মানবের দল
সিংহাসন রাজদণ্ড ঐশ্বর্য মুকুট
প্রভুত্ব রাজত্ব আর গৌরবের তরে।

ওই দেখো গুপ্তহত্যা করিয়া বহন
চলিতেছে অঙ্গুলির ‘পরে ভর দিয়া
চুপি চুপি ধীরে ধীরে অলক্ষিত ভাবে
তলবার হাতে করি চলিয়াছে দেখো।

হত্যা করিতেছে দেখো নিদ্রিত মানবে
সুখের আশয়ে বৃথা সুখের আশয়ে
ওই দেখো ওই দেখো রক্তমাখা হাতে
ধরিয়াছে রাজদণ্ড সিংহাসনে বসি।

কিন্তু হায় সুখলেশ পাবে কি কখন?
সুখ কি তাহারে করিবেক আলিঙ্গন?
সুখ কি তাহার হৃদে পাতিবে আসন?
সুখ কভু তারে কিগো কটাক্ষ করিবে?

নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
বৃষ্টি বজ্র সহ্য করি যে সুখের তরে
ছুটিয়াছে আপনার অভীষ্ট সাধনে?

কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়
পাপের কী ফল কভু সুখ হতে পারে
পাপের কী শাস্তি হয় আনন্দ ও সুখ
কখনোই নয় তাহা কখনোই নয়

প্রজ্বলিত অনুতাপ হুতাশন কাছে
বিমল সুখের হায় স্নিগ্ধ সমীরণ
হুতাশনসম তপ্ত হয়ে উঠে যেন
তখন কি সুখ কভু ভালো লাগে আর।

নরহত্যা করিয়াছে যে সুখের তরে
যে সুখের তরে পাপে ধর্ম ভাবিয়াছে
ছুটেছে না মানি বাধা অভীষ্ট সাধনে
মনস্তাপে পরিণত হয়ে উঠে শেষে।

হৃদয়ের উচ্চাসনে বসি অভিলাষ
মানবদিগকে লয়ে ক্রীড়া কর তুমি
কাহারে বা তুলে দাও সিদ্ধির সোপানে
কারে ফেল নৈরাশ্যের নিষ্ঠুর কবলে।

কৈকেয়ী হৃদয়ে চাপে দুষ্ট অভিলাষ!
চতুর্দশ বর্ষ রামে দিলে বনবাস,
কাড়িয়া লইলে দশরথের জীবন,
কাঁদালে সীতায় হায় অশোক- কাননে।

রাবণের সুখময় সংসারের মাঝে
শান্তির কলস এক ছিল সুরক্ষিত
ভাঙিল হঠাৎ তাহা ভাঙিল হঠাৎ
তুমিই তাহার হও প্রধান কারণ।

দুর্যোধন- চিত্ত হায় অধিকার করি
অবশেষে তাহারেই করিলে বিনাশ
পাণ্ডুপুত্রগণে তুমি দিলে বনবাস
পাণ্ডবদিগের হৃদে ক্রোধ জ্বালি দিলে।

নিহত করিলে তুমি ভীষ্ম আদি বীরে
কুরুক্ষেত্র রক্তময় করে দিলে তুমি
কাঁপাইলে ভারতের সমস্ত প্রদেশ
পাণ্ডবে ফিরায়ে দিলে শূন্য সিংহাসন।

বলি না হে অভিলাষ তোমার ও পথ
পাপেতেই পরিপূর্ণ পাপেই নিম্নিত
তোমার কতকগুলি আছয়ে সোপান
কেহ কেহ উপকারী কেহ অপকারী।

উচ্চ অভিলাষ! তুমি যদি নাহি কভু
বিস্তারিতে নিজ পথ পৃথিবীমণ্ডলে
তাহা হ’লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল- মাঝে?

সকলেই যদি নিজ নিজ অবস্থায়
সন্তুষ্ট থাকিত নিজ বিদ্যা বুদ্ধিতেই
তাহা হ’লে উন্নতি কি আপনার জ্যোতি
বিস্তার করিত এই ধরাতল- মাঝে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা হোক্‌ ভারতের জয়!

এসো এসো ভ্রাতৃগণ! সরল অন্তরে
সরল প্রীতির ভরে
সবে মিলি পরস্পরে
আলিঙ্গন করি আজ বহুদিন পরে।
এসেছে জাতীয় মেলা ভারতভূষণ,
ভারত সমাজে তবে
হৃদয় খুলিয়া সবে
এসো এসো এসো করি প্রিয়সম্ভাষণ।

দূর করো আত্মভেদ বিপদ- অঙ্কুর,
দূর করো মলিনতা
বিলাসিতা অলসতা,
হীনতা ক্ষীণতা দোষ করো সবে দূর।
ভীরুতা বঙ্গীয়জন- কলঙ্ক- প্রধান-
সে- কলঙ্ক দূর করো,
সাহসিক তেজ ধরো,
স্বকার্যকুশল হও হয়ে একতান।

হল না কিছুই করা যা করিতে এলে-
এই দেখো হিন্দুমেলা,
তবে কেন কর হেলা?
কী হবে কী হবে আর তুচ্ছ খেলা খেলে?
সাগরের স্রোতসম যাইছে সময়।
তুচ্ছ কাজে কেন রও,
স্বদেশহিতৈষী হও-
স্বদেশের জনগণে দাও রে অভয়।

নাহি আর জননীর পূর্বসুতগণ-
হরিশ্চন্দ্র যুধিষ্ঠির
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীর,
অনন্তজলধিতলে হয়েছে মগন।

নাহি সেই রাম আদি সম্রাট প্রাচীন,
বিক্রম- আদিত্যরাজ,
কালিদাস কবিরাজ,
পরাশর পারাশর পণ্ডিত প্রবীণ।
সকলেই জল বায়ু তেজ মৃত্তিকায়
মিশাইয়া নিজদেহ
অনন্ত ব্রহ্মের গেহ
পশেছে কীর্তিরে শুধু রাখিয়ে ধরায়।

আদরে সে প্রিয় সখী আচ্ছাদি গগনে
সে লোকবিশ্রুত নাম
সে বিশ্ববিজয়ী ধাম
নির্ঘোষে ঘুষিছে সদা অখিল ভুবনে।
যবনের রাজ্যকালে কীর্তির আধার
চিতোর- নগর নাম
অতুলবীরত্বধাম,
কেমন ছিল রে মনে ভাবো একবার।

এইরূপ কত শত নগর প্রাচীন
সুকীর্তি- তপন- করে
ভারত উজ্জ্বল ক’রে
অনন্ত কালের গর্ভে হয়েছে বিলীন।
নাহি সেই ভারতের একতা- বিভব,
পাষাণ বাঁধিয়া গলে
সকলের পদতলে
লুটাইছে আর্যগণ হইয়া নীরব।

গেল, হায়, সব সুখ অভাগী মাতার-
ছিল যত মনোআশা
নিল কাল সর্বনাশা,
প্রসন্ন বদন হল বিষণ্ণ তাঁহার।
কী আর হইবে মাতা খুলিয়া বদন।
দীপ্তভানু অস্ত গেল,
এবে কালরাত্রি এল, বসনে আবরি মুখ কাঁদো সর্বক্ষণ।

বিশাল অপার সিন্ধু, গভীর নিস্বনে
যেখানে যেখানে যাও
কাঁদিতে কাঁদিতে গাও-
ডুবিল ভারতরবি অনন্ত জীবনে।
সুবিখ্যাত গৌড় যেই বঙ্গের রতন-
তার কীর্তিপ্রতিভায়
খ্যাতাপন্ন এ ধরায়
হয়েছিল একদিন বঙ্গবাসিগণ।

গেল সে বঙ্গের জ্যোতিঃ কিছুকাল পরে-
কোনো চিহ্ন নাহি তার,
পরিয়া হীনতাহার,
ডুবিয়াছে এবে বঙ্গ কলঙ্কসাগরে।
হিন্দুজনভ্রাতৃগণ! করি হে বিনয়-
একতা উৎসাহ ধরো,
জাতীয় উন্নতি করো,
ঘুষুক ভুবনে সবে ভারতের জয়।

জগদীশ! তুমি, নাথ, নিত্য- নিরাময়
করো কৃপা বিতরণ,
অধিবাসিজনগণ,
করুক উন্নতি- হোক্‌ ভারতের জয়!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ

জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ,
পরাণ সঁপিবে বিধবা- বালা।
জ্বলুক্‌ জ্বলুক্‌ চিতার আগুন,
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা॥
শোন্‌ রে যবন! – শোন্‌ রে তোরা,
যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে,
সাক্ষী র’লেন দেবতা তার
এর প্রতিফল ভুগিতে হবে॥

ওই যে সবাই পশিল চিতায়,
একে একে একে অনলশিখায়,
আমরাও আয় আছি যে কজন,
পৃথিবীর কাছে বিদায় লই।
সতীত্ব রাখিব করি প্রাণপণ,
চিতানলে আজ সঁপিব জীবন-
ওই যবনের শোন্‌ কোলাহল,
আয় লো চিতায় আয় লো সই!
জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ, দ্বিগুণ,
অনলে আহুতি দিব এ প্রাণ।

জ্বলুক্‌ জ্বলুক্‌ চিতার আগুন,
পশিব চিতায় রাখিতে মান।
দেখ্‌ রে যবন! দেখ্‌ রে তোরা!
কেমনে এড়াই কলঙ্ক- ফাঁসি;
জ্বলন্ত অনলে হইব ছাই,
তবু না হইব তোদের দাসী॥

আয় আয় বোন! আয় সখি আয়!
জ্বলন্ত অনলে সঁপিবারে কায়,
সতীত্ব লুকাতে জ্বলন্ত চিতায়,
জ্বলন্ত চিতায় সঁপিতে প্রাণ!
দেখ্‌ রে জগৎ, মেলিয়ে নয়ন,
দেখ্‌ রে চন্দ্রমা দেখ্‌ রে গগন!
স্বর্গ হতে সব দেখ্‌ দেবগণ,
জলদ- অক্ষরে রাখ্‌ গো লিখে।
স্পর্ধিত যবন, তোরাও দেখ্‌ রে,
সতীত্ব- রতন, করিতে রক্ষণ,
রাজপুত সতী আজিকে কেমন,
সঁপিছে পরান অনল- শিখে॥

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ভারতী

শুধাই অয়ি গো ভারতী তোমায়
তোমার ও বীণা নীরব কেন?
কবির বিজন মরমে লুকায়ে
নীরবে কেন গো কাঁদিছ হেন?
অযতনে, আহা, সাধের বীণাটি
ঘুমায়ে রয়েছে কোলের কাছে,
অযতনে, আহা, এলোথেলো চুল
এদিকে- ওদিকে ছড়িয়ে আছে।

কেন গো আজিকে এ- ভাব তোমার
কমলবাসিনী ভারতী রানী-
মলিন মলিন বসন ভূষণ
মলিন বদনে নাহিকো বাণী।
তবে কি জননি অমৃতভাষিণি
তোমার ও বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও বীণা আর না বাজিবে তবে?

দেখো তবে মাতা দেখো গো চাহিয়া
তোমার ভারত শ্মশান- পারা,
ঘুমায়ে দেখিছে সুখের স্বপন
নরনারী সব চেতনহারা।
যাহা- কিছু ছিল সকলি গিয়াছে,
সে- দিনের আর কিছুই নাই,
বিশাল ভারত গভীর নীরব,
গভীর আঁধার যে- দিকে চাই।

তোমারো কি বীণা ভারতি জননী,
তোমারো কি বীণা নীরব হবে?
ভারতের এই গগন ভরিয়া
ও- বীণা আর না বাজিবে তবে?
না না গো, ভারতী, নিবেদি চরণে
কোলে তুলে লও মোহিনী বীণা।
বিলাপের ধ্বনি উঠাও জননি,
দেখিব ভারত জাগিবে কি না।

অযুত অযুত ভারতনিবাসী
কাঁদিয়া উঠিবে দারুণ শোকে,
সে রোদনধ্বনি পৃথিবী ভরিয়া
উঠিবে, জননি, দেবতালোকে।
তা যদি না হয় তা হলে, ভারতি,
তুলিয়া লও বিজয়ভেরী,
বাজাও জলদগভীর গরজে
অসীম আকাশ ধ্বনিত করি।

গাও গো হুতাশ- পূরিত গান,
জ্বলিয়া উঠুক অযুত প্রাণ,
উথলি উঠুক ভারত- জলধি-
কাঁপিয়া উঠুক অচলা ধরা।
দেখিব তখন প্রতিভাহীনা
এ ভারতভূমি জাগিবে কি না,
ঢাকিয়া বয়ান আছে যে শয়ান
শরমে হইয়া মরমে- মরা!

এই ভারতের আসনে বসিয়া
তুমিই ভারতী গেয়েছ গান,
ছেয়েছে ধরার আঁধার গগন
তোমারি বীণার মোহন তান।
আজও তুমি, মাতা, বীণাটি লইয়া
মরম বিঁধিয়া গাও গো গান-
হীনবল সেও হইবে সবল,
মৃতদেহ সেও পাইবে প্রাণ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা আগমনী

সুধীরে নিশার আঁধার ভেদিয়া
ফুটিল প্রভাততারা।
হেথা হোথা হতে পাখিরা গাহিল
ঢালিয়া সুধার ধারা।
মৃদুল প্রভাতসমীর পরশে
কমল নয়ন খুলিল হরষে,
হিমালয় শিরে অমল আভায়
শোভিল ধবল তুষারজটা।

খুলি গেল ধীরে পূরবদ্বার,
ঝরিল কনককিরণধার,
শিখরে শিখরে জ্বলিয়া উঠিল,
রবির বিমল কিরণছটা।
গিরিগ্রাম আজি কিসের তরে,
উঠেছে নাচিয়া হরষভরে,
অচল গিরিও হয়েছে যেমন
অধীর পাগল- পারা।

তটিনী চলেছে নাচিয়া ছুটিয়া,
কলরব উঠে আকাশে ফুটিয়া,
ঝর ঝর ঝর করিয়া ধ্বনি
ঝরিছে নিঝরধারা।
তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া মালা,
চলিয়াছে গিরিবাসিনী বালা,
অধর ভরিয়া সুখের হাসিতে
মাতিয়া সুখের গানে।

মুখে একটিও নাহিকো বাণী
শবদচকিতা মেনকারানী
তৃষিত নয়নে আকুল হৃদয়ে,
চাহিয়া পথের পানে।
আজ মেনকার আদরিণী উমা
আসিবে বরষ- পরে।
তাইতে আজিকে হরষের ধ্বনি
উঠিয়াছে ঘরে ঘরে।

অধীর হৃদয়ে রানী আসে যায়,
কভু বা প্রাসাদশিখরে দাঁড়ায়,
কভু বসে ওঠে, বাহিরেতে ছোটে
এখনো উমা মা এলনা কেন?
হাসি হাসি মুখে পুরবাসীগণে
অধীরে হাসিয়া ভূধরভবনে,
“কই উমা কই’ বলে “উমা কই’,
তিলেক বেয়াজ সহে না যেন!
বরষের পরে আসিবেন উমা
রানীর নয়নতারা,
ছেলেবেলাকার সহচরী যত
হরষে পাগল- পারা।

ভাবিছে সকলে আজিকে উমায়
দেখিবে নয়ন ভ’রে,
আজিকে আবার সাজাব তাহায়
বালিকা উমাটি ক’রে।
তেমনি মৃণালবলয়- যুগলে,
তেমনি চিকন- চিকন বাকলে,
তেমনি করিয়া পরাব গলায়
বনফুল তুলি গাঁথিয়া মালা।

তেমনি করিয়া পরায়ে বেশ
তেমনি করিয়া এলায়ে কেশ,
জননীর কাছে বলিব গিয়ে
“এই নে মা তোর তাপসী বালা’।
লাজ- হাসি- মাখা মেয়ের মুখ
হেরি উথলিবে মায়ের সুখ,
হরষে জননী নয়নের জলে
চুমিবে উমার সে মুখখানি।

হরষে ভূধর অধীর- পারা
হরষে ছুটিবে তটিনীধারা,
হরষে নিঝর উঠিবে উছসি,
উঠিবে উছসি মেনকারানী।
কোথা তবে তোরা পুরবাসী মেয়ে
যেথা যে আছিস আয় তোরা ধেয়ে
বনে বনে বনে ফিরিবি বালা,
তুলিবি কুসুম, গাঁথিবি মালা,
পরাবি উমার বিনোদ গলে।

তারকা- খচিত গগন- মাঝে
শারদ চাঁদিমা যেমন সাজে
তেমনি শারদা অবনী শশী
শোভিবে কেমন অবনীতলে!
ওই বুঝি উমা, ওই বুঝি আসে,
দেখো চেয়ে গিরিরানী!
আলুলিত কেশ, এলোথেলো বেশ,
হাসি- হাসি মুখখানি।

বালিকারা সব আসিল ছুটিয়া
দাঁড়াল উমারে ঘিরি।
শিথিল চিকুরে অমল মালিকা
পরাইয়া দিল ধীরি।
হাসিয়া হাসিয়া কহিল সবাই
উমার চিবুক ধ’রে,
“বলি গো স্বজনী, বিদেশে বিজনে
আছিলি কেমন করে?

আমরা তো সখি সারাটি বরষ
রহিয়াছি পথ চেয়ে-
কবে আসিবেক আমাদের সেই
মেনকারানীর মেয়ে!
এই নে, সজনী, ফুলের ভূষণ
এই নে, মৃণাল বালা,
হাসিমুখখানি কেমন সাজিবে
পরিলে কুসুম- মালা।’

কেহ বা কহিল, “এবার স্বজনি,
দিব না তোমায় ছেড়ে
ভিখারি ভবের সরবস ধন
আমরা লইব কেড়ে।
বলো তো স্বজনী, এ কেমন ধারা
এয়েছ বরষ- পরে,
কেমনে নিদিয়া রহিবে কেবল
তিনটি দিনের তরে।’

কেহ বা কহিল, “বলো দেখি, সখী,
মনে পড়ে ছেলেবেলা?
সকলে মিলিয়া এ গিরিভবনে
কত- না করেছি খেলা!
সেই মনে পড়ে যেদিন স্বজনী
গেলে তপোবন- মাঝে-
নয়নের জলে আমরা সকলে
সাজানু তাপসী- সাজে।

কোমল শরীরে বাকল পরিয়া
এলায়ে নিবিড় কেশ
লভিবারে পতি মনের মতন
কত- না সহিলে ক্লেশ।
ছেলেবেলাকার সখীদের সব
এখনো তো মনে আছে,
ভয় হয় বড়ো পতির সোহাগে
ভুলিস তাদের পাছে!’

কত কী কহিয়া হরষে বিষাদে
চলিল আলয়- মুখে,
কাঁদিয়া বালিকা পড়িল ঝাঁপায়ে
আকুল মায়ের বুকে।
হাসিয়া কাঁদিয়া কহিল রানী,
চুমিয়া উমার অধরখানি,
“আয় মা জননি আয় মা কোলে,
আজ বরষের পরে।

দুখিনী মাতার নয়নের জল
তুই যদি, মা গো, না মুছাবি বল্‌
তবে উমা আর, কে আছে আমার
এ শূন্য আঁধার ঘরে?
সারাটি বরষ যে দুখে গিয়াছে
কী হবে শুনে সে ব্যথা,
বল্‌ দেখি, উমা, পতির ঘরের
সকল কুশল- কথা।’

এত বলি রানী হরষে আদরে
উমারে কোলেতে লয়ে,
হরষের ধারা বরষি নয়নে
পশিল গিরি- আলয়ে।
আজিকে গিরির প্রাসাদে কুটিরে
উঠিল হরষ- ধ্বনি,
কত দিন পরে মেনকা- মহিষী
পেয়েছে নয়নমণি!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা গুলো আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Channel Join Now

Leave a Comment